মেয়ের বিয়ে

মেয়ের বিয়ে
– বিপত্তারন ঘোষাল

 

 

৭মাস আগে থেকে মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছে,কাল একে বায়না দিলাম তো আজ ওকে।একেবারে হিমসিম খেয়ে পড়ছে মানুষটা।চোখে ঘুম নেই,রাতের পর রাত জেগেই কেটে যাচ্ছে।চিন্তায় কপালের শিরায় যেন টান দেখা যাচ্ছে।বাবার মন জুড়ে শুধু একটাই দুঃশ্চিন্তা,পাছে এই বিয়েতে আমাদের কিছু ত্রুটি থেকে যায়।আমি বারবার বলি বাবাকে যে, তুমি এতো চিন্তা করোনা,এমনিতেই তোমার শরীর অসুস্থ।তারপর আবার যদি তুমি চিন্তায় ভেঙ্গে পড়ো,তাহলে আমি চলে যাবার পর এ বাড়ি কে সামলাবে? নাও! কোলেপিঠে করে যখন মানুষ করতে পেরেছো,জীবনের কঠিন অধ্যায়গুলো আমার সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিতে পেরেছো,তখন আমি নিশ্চিত যে আমার বিয়েটাও ঠিকমতো পার হয়ে যাবে।একরাশ কষ্ট বুকে চেপে দুহাত দিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে বাবার হিম্মত জোগালো মা-হারা ঝিলিকটা।ওদিকে তখন চোখের কোণে অশ্রু সরিয়ে ঠোঁট চেপে করুণ স্বরে বাবা বলে উঠলেন‍;
– “তুই ঠিক আমার মায়ের মতো হয়েছিস! আর তাই তো আমার মনের কথা সব বুঝতে পারিস।ছাড়! যাই হোক,  বলি তৃহাণের সাথে আবার বেশি রাগ করিস না ক্ষেপী,আর ঐ বাড়ির গুরুজনদের কথা ভালোভাবে মান্য করিস,সকলের খেয়াল রাখিস কেমন!”
ছলছল চোখে ঝিলিক বলে উঠল; হ্যাঁ বাবা নাও,ওবাড়ির খেয়াল রাখার মানুষ অনেক আছে,আমার চিন্তা শুধু তোমায় নিয়ে।তুমি খামকা এতো চিন্তে করছো আমায় নিয়ে,তুমি বরং আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো…
– “খালি হাতে একদম আর ভাতের হাড়ি নামাবে না,অফিস যাওয়ার আগে জামার কলার্টটা ঠিক করবে,বোতাম গুলো অন্তত ঠিকমতো লাগাবে,আর তাড়াহুড়োয় আবার পকেটে রুমাল,মানিব্যাগগুলো নিতে ভুলে যেওনা,সময় করে চুলটা আছড়াবে,এই ক্ষেপীর কাজগুলো কিন্তু এবার থেকে তোমাকেই করতে হবে,আর হ্যাঁ মনে করে প্রতিদিন ঔষধগুলো ঠিকমতো খাবে,আমি যেন না দেখি যে তোমার শরীর আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
– আচ্ছা! আচ্ছা! মনে থাকবে নে।
বিয়ের দিন সকাল থেকেই ক্রমে ক্রমে বাড়িতে আত্মীয়ের ভিড় বাড়ছে।ওদিকে বাবা দম নেওয়ার সময় পর্যন্ত পাচ্ছে না।কন্যা সম্প্রদানের ভার মামার কাঁধে।সন্ধ্যে হতেই সানাই এর সুর কানে ভেসে আসছে।পাড়ার বান্ধবীরা গোল করে সব ঘিরে বসেছে,আমায় নিয়ে হাজার কৌতুহল তাদের।খানিক পরে কনে সাজানোর দিদি এসে হাজির।গল্পছেড়ে সাজতে বসলাম।সাজ শেষে বাইরে আসতেই সব আমায় নিয়ে সেলফি তুলতে ব্যস্ত।সবার মুখে এককথা- কি অপূর্ব লাগছে ঝিলিক মা,তোকে ফাটাফাটি লাগছে দিদি ইত্যাদি ইত্যাদি! সবাই দেখছি বেশ সেজেগুজে তৈরী।ভিড় সরিয়ে বাবার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি,তখনও মানুষটা সেই সকালের ঢলঢলে জামা পরে একবার এদিকে দৌড়াচ্ছে,তো একবার ঐদিক সামলাচ্ছে।বাবার কাছে গিয়ে ক্ষিপ্ত স্বরে বললাম;
তুমি কখন আর তৈরী হবে বলো তো? যাও এক্ষুনি, আমি বরং এদিকটা দেখছি। টিফিন প্যাকেটিং শেষ।আলুখালু কলার্ট,অগোছালো চুল,জামার বোতাম আবার সেই খোলা বেশে এসে আমায় সরিয়ে …. যাহ্ যাহ্ ঝিলিক! তুই আর এখানে এক মুহূর্ত থাকিস না,এক্ষুনি বরপক্ষ এলো বলে।আমি আর কিছু না বলে,বাবার হাত চেপে চেয়ারে বসিয়ে,জামার কলার্ট ঠিক করে,বোতামগুলো ঠিকমতো লাগিয়ে,বাবার চুল আছড়ে দিতে দিতে কেঁদে ফেললাম।
– “বাবা!এবার তো অন্তত একটু নিজের খেয়াল রাখো,কাল থেকে তো তোমাকে এগুলো নিজেকেই করতে হবে নাকি!”
– বাবার চোখ ছলছল,আর সামলাতে না পেরে,মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়ার স্বরে বলে উঠল,’ক্ষেপী! কাল থেকে আর হয়তো তোর এই সারাজীবনের কাজটা,আমায় কেউ আর করে দেবে না।’
সমাপ্ত

Loading

Leave A Comment